কালীমাতা তত্ত্ব

কালী কে?
যে কাল সর্বজীবের গ্রাসকারী, সেই কালেরও যিনি গ্রাসকারিণী তিনিই কালী। কালেরও নিয়ন্ত্রী শক্তি আছে। একথা সত্য যে, কালশক্তি-প্রভাবেই জগতের উৎপত্তি ও স্থিতি; মহাপ্রলয়ের সেই মহাকালই পুনশ্চ সমগ্র সৃষ্টিকে গ্রাসকারী। কিন্তু মহাকাল সেও পরিণামের অধীন। মহাপ্রলয়ে কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষ লীন হয়ে যায়।
আদ্যাশক্তি
কালী আদ্যাশক্তিরূপিণী। কারণ তিনিই নিখিল বিশ্বের আদি শক্তি, শক্তির বীজ। ঋগ্বেদে ১০:১২৯:৩ মন্ত্রে বলা আছে- তৎকালে পৃথিবীও ছিল না, আকাশও ছিল না; তা হতে উন্নত স্থলও ছিল না। তবে কিছুই কি ছিল না?… এক সুগভীর আতিহীন, অন্তহীন অন্ধকার ছিলো।
এই অনাদি অন্ধকারকে তন্ত্রশাস্ত্র নাম দিয়েছে আদ্যাশক্তি কালীরূপে।
সংহারমূর্তি কী?
বলা হয় মা কালীল মূর্তি সংহারকারীণি মূর্তি। সংহারের প্রকৃত অর্থ- সংহরণ, নিজের ভেতর প্রত্যাকর্ষণ। যেমন সমুদ্র থেকে উৎপন্ন ঢেউ সমুদ্রেই লীন হয়, যেমন মাকড়সা স্বীয় জাল ইচ্ছানুসারে
নিজের ভেতরেই গুটিয়ে নিতে পারে তেমনি। জেলে যেভাবে জাল বিস্তার করে পুনরায় নিজের দিকে টেনে নেয় তেমনি। (শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে- নজরুল)। অর্থাৎ এই সংহার মানে পুনসৃষ্টি কেবলই ধ্বংস নয়। এই সংহার অর্থ নির্ভয় আশ্রয় মাতৃকোলে ও মাতৃবক্ষে সন্তানের প্রত্যাবর্তন। নিখিল সৃষ্টি বিশ্বপ্রসবিণী মায়ের উদর হতেই আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা সেখানেই ফিরে যাই।
শিবের বুকে কেন কালী?
শিবের বুকে কালী কেননা শিব রূপে মা কালী নির্গুণ ঈশ্বর আর সগুণ রূপে তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের নিয়ন্ত্রী। মা কখনো নিস্ক্রিয়া- যখন কোনো সৃষ্টিই ছিল না তখন নিস্ক্রিয়া। কখনো সক্রিয়া- যখন সৃষ্টির প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে তখন সগুণ সক্রিয়া। নির্গুণ ঈশ্বরের বুকে যখন শক্তির প্রকাশ ঘটে তখনই তা সৃষ্টি সক্ষম হয়ে ওঠে। তাই নির্গুণ শিবের বুকে শক্তিরূপিণী মা। তিনিই শিব, তিনিই কালী।
মা কেন দিগম্বরী?
মা দিগাম্বরী, বসনহীন। কেননা ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সর্ববৃহৎ তাকে আচ্ছাদিত করার মতো আর বৃহৎ কিছু নেই। তাই মা বসনহীন। এই আচ্ছাদন অবিদ্যা ও অহং এর প্রতীক। সকল অবিদ্যা, মোহ ও অহমিকার আচ্ছাদন পরিত্যাগ করলে তবেই ঈশ্বরের দেখা মেলে।
মায়ের গলায় কেন মুণ্ডমালা?
মায়ের গলায় মুণ্ডমালা। কারণ মা বাগীশ্বরী, শব্দব্রহ্মময়ী। তার কণ্ঠে পঞ্চাশ মুণ্ড, পঞ্চাশটি বর্ণের প্রতীক। জগতের সকল জ্ঞান ও তত্ত্বের প্রকাশ হয় এই বর্ণ তথা ধ্বনির মাধ্যমে। মা সকল জ্ঞানশক্তির আধার তাই তার গলায় মুণ্ডমালা। মস্তিষ্ক হচ্ছে জ্ঞানের আধার। মায়ের হাতে ঝুলন্ত মস্তিষ্ক আমাদের জ্ঞানশক্তিতে বলিয়ান হতে শিক্ষা দেয়। জ্ঞান দ্বারাই আমরা অজ্ঞানকে ছেদন করতে পারি।
মায়ের কটিদেশে কেন কাটা হাত?
মায়ের কটিদেশে কাটা হাত। হাত হচ্ছে কর্মের প্রতীক। জীবের জন্ম-জন্মান্তর প্রক্রিয়া এই কর্মের দ্বারাই নির্ধারিত। সকাম কর্ম বন্ধনের কারণ তাই কর্তিত হাত মায়ের যোনিদেশের কাছাকাছি। অর্থাৎ সকাম কর্মকে পরিত্যাগ না করতে পারলে জন্মান্তর অবশ্যম্ভাবী। একারণেই মা ছিন্ন হস্ত কটিদেশে ধারণ করে আছেন।
কেন মা চতুর্ভুজা?
শ্রীশ্রী কালী চতুর্ভুজা। সকাম ও নিষ্কাম, সাধক সাধারণত এই দুই প্রকার। সকাম সাধন সংসারে সাফল্য চান আর নিষ্কাম সাধক চান মুক্তি। মায়ের দক্ষিণ হাতে সকাম সাধককে অভয় ও বর দিচ্ছেন আর বাম হাতে খড়গ দ্বারা নিষ্কাম সাধককে মোহপাশ ছিন্ন করতে বলছেন। কালো কেশ আকর্ষণ করে মা তমোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলছেন। যেহেতু রক্ত রাজসিক গুণের প্রতীক তাই মা মস্তিষ্ক থেকে অসারিত রুধির ধারা শোষিত করে সত্ত্বগুণে উন্নীত হতে শিক্ষা দিচ্ছেন।
গীতায় বর্ণিত সাতশত শ্লোকের যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান তাই লুকায়িত আছেন মা কালীর প্রতিমায়। গীতায় অর্জুনকে উপদেশ ছলে নিষ্কাম কর্ম শিখিয়েছেন ভগবান আর চণ্ডীতে বর্ণিত মাতৃরূপের এই প্রতিমা আমাদেরকে প্রতীক ও ব্যঞ্জনায় গীতার সমগ্র দর্শনকেই ধারণ করছে। কালী কৃষ্ণে নেই কোনো প্রভেদ-
ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরি সংক্ষয়ম। (চণ্ডী, ১১ : ৫৫)
অনুবাদ: এইরূপে যখনই যখনই জগতে দানবের অত্যাচার হবে, তখনই তখনই আমি পুনঃপুনঃ আবির্ভূতা হয়ে জগতের সেই শত্রুগণকে ধ্বংস করবো।
অন্যদিকে গীতার সেই অভয়বাণী-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ (গীতা, ৪:৭)
অনুবাদ: হে ভারত! যখনই ধর্মের হানি ও অধর্মের বৃদ্ধি হয়, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি।
সকল দেবতা যেমন শ্রীকৃষ্ণের শরীরে অবস্থিত- এমন বিশ্বরূপ দেখেছিলেন অর্জুন, তেমনি চণ্ডীতে মা দুর্গাও সেইরূপই প্রকট হয়েছেন।
একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতাদুষ্ট ময়্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ॥ (চণ্ডী, ১০:৫)
অনুবাদ: এই জগতে আমি একা আছি, আমি ভিন্ন দ্বিতীয় আর কে আছে? … ব্রহ্মণী প্রভৃতি শক্তি আমারই অভিন্না বিভূতি, উহারা আমাতেই প্রবেশ করিতেছে।
আরও অনেককিছু না বলাই থেকে গেলো। শুধু এতটুকু ভাববার ঈশ্বরের কত নিগূঢ় ও গভীর দার্শনিক চিন্তা আমাদের ঋষিরা করেছিলেন। কী অসম্ভব তত্ত্ব, জীবন ও জগতের কী অভাবনীয় প্রকাশ এই প্রতিমা! আশ্চর্য হতে হয় আমাদের ধর্মে এই উচ্চস্তরের চিন্তাচেতনার কথা মনে করলে। কিন্তু যদি আমরা এগুলো সঠিক ভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে না পারি, যদি দার্শনিক চিন্তা চেতনাগুলোকে মানুষের মাঝে উপস্থাপন না করতে পারি তবে সবই অর্থহীন হয়ে যায়। বিদ্যার্থী সংসদ সেইসব চিন্তার প্রসার ও প্রচার কাজ করুক। মায়ের পূজার এই তিথিতে এই হোক সকলের ব্রত।