শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষোড়শ অধ্যায় – দৈবাসুর-সম্পদ্‌-বিভাগযোগ

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষোড়শ অধ্যায় – দৈবাসুর-সম্পদ্‌-বিভাগযোগ

শ্রীভগবানুবাচ
অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধির্জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ ।
দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্ ॥১॥
অহিংসা সত্যমক্রোধস্ত্যাগঃ শান্তিরপৈশুনম্ ।
দয়া ভূতেষ্বলোলুপ্তং মার্দবং হ্রীরচাপলম্ ॥২॥
তেজঃ ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা ।
ভবন্তি সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত ॥৩॥
শ্রীভগবান্‌ বললেন –
নির্ভীকতা, চিত্তসূদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা ও কর্মযোগে তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র-অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দাবরজন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা (অক্রৌর্য), কু-কর্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, দ্রোহ বা হিংসা না করা, অনভিমান, – হে ভারত, এই সকল গুণ দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জাত পুরুষের হইয়া থাকে । ১,২,৩ (অর্থাৎ যাঁহারা পূর্বজন্মের কর্মফলে দৈবী সম্পদ্‌ ভোগার্থ জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাদেরই এই সকল সাত্ত্বিক গুণ জন্মিয়া থাকে) ।
দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পাদমাসুরীম্ ॥৪॥
হে পার্থ, দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞান আসুরী সম্পদ্‌-অভিমুখে জাত ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ এই সকল রাজসিক এবং তামসিক প্রকৃতির লোকের ধর্ম । ৪
দৈবী সম্পদ্ বিমোক্ষায় নিবন্ধায়াসুরী মতা ।
মা শুচঃ সম্পদং দৈবীমভিজাতোহসি পাণ্ডব ॥৫॥
দৈবী সম্পদ্‌ মোক্ষের হেতু এবং আসুরী সম্পদ্‌ সংসার-বন্ধনের কারণ হয় । হে পাণ্ডব, শোক করিও না; কারণ তুমি দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জন্মিয়াছ । ৫
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ ৷
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু ॥৬॥
হে পার্থ, এ জগতে দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি হয় । দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা সবিস্তার করিয়াছি, এক্ষণে আসুরী প্রকৃতির কথা আমার নিকট শ্রবণ কর । ৬
প্রবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ ৷
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে ॥৭॥
আসুরভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ জানে না যে, ধর্মে প্রবৃত্তিই বা কি আর অধর্ম হইতে নিবৃত্তিই বা কি, অর্থাৎ তাহাদের ধর্মাধর্ম, কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান নাই । অতএব তাহাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার বা সত্য কিছুই নাই । ৭
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ৷
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ॥৮॥
এই আসুর প্রকৃতির লোকেরা বলিয়া থাকে যে, এই জগতে সত্য বলিয়া কোন পদার্থ নাই, সকলই অসত্য; জগতে ধর্মাধর্মেরও কোন ব্যবস্থা নাই এবং ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর বলিয়াও কোন বস্তু নাই । ইহা কেবল স্ত্রী-পুরুষের অন্যোন্যসংযোগে জাত (কামসম্ভূত) । স্ত্রী-পুরুষের কামই ইহার একমাত্র কারণ, ইহার অন্য কারণ নাই । ৮
এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ ৷
প্রভবন্ত্ত্যগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ ॥৯॥
পূর্বোক্ত দৃষ্টি (নিরীশ্বরবাদীদিগের মত) অবলম্বন করিয়া বিকৃতমতি, অল্পবুদ্ধি ক্রূরকর্মা ব্যক্তিগণ অহিতাচরণে প্রবৃত্ত হয়; তাহারা জগতের বিনাশের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে । ৯
কামমাশ্রিত্য দুঃষ্পূরং দম্ভমানমদান্বিতাঃ ৷
মোহাদ্ গৃহীত্বাসদ্ গ্রাহান্ প্রবর্তন্তেহশুচিব্রতাঃ ॥১০॥
যাহা কখনও পূর্ণ হইবার নহে, এইরূপ কামনার বশীভূত হইয়া দম্ভ, অভিমান ও গর্বে মত্ত হইয়া, তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা স্ত্রী-রত্নাদি প্রাপ্ত হইব, অবিবেকবশতঃ এইরূপ দুরাশার বশবর্তী হইয়া অশুচিব্রত অবলম্বন করতঃ তাহারা কর্মে (ক্ষুদ্র দেবতাদির উপাসনায়) প্রবৃত্ত হইয়া থাকে । ১০
চিন্তামপরিমেয়াং চ প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ৷
কামোপভোগপরমা এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ ॥১১॥
আশাপাশশতৈর্বদ্ধাঃ কামক্রোধ পরায়ণাঃ ।
ঈহন্তে কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্ ॥১২॥
মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপরিমেয় বিষয়-চিন্তা আশ্রয় করিয়া (যাবজ্জীবন নিরন্তর বিষয়চিন্তাপরায়ণ হইয়া) বিষয়ভোগনিরত এই সকল ব্যক্তি নিশ্চয় করে যে, কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ, এতদ্ব্যতীত জীবনের অন্য লক্ষ্য নাই, সুতরাং ইহারা শত শত আশাপাশে বদ্ধ এবং কামক্রোধপরায়ণ হইয়া অসৎ মার্গ অবলম্বনপূর্বক অর্থ-সংগ্রহে সচেষ্ট হয় । ১১,১২
ইদমদ্য ময়া লব্ধমিমং প্রাপ্স্যে মনোরথম্ ।
ইদমস্তীদমপি মে ভবিষ্যতি পুনর্ধনম্ ॥১৩॥
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি ।
ঈশ্বরোহহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্ সুখী ॥১৪॥
আঢ্যোহভিজনবানস্মি কোহন্যোহস্তি সদৃশো ময়া ।
যক্ষ্যে দাস্যামি মোদিষ্য ইত্যজ্ঞানবিমোহিতাঃ ॥১৫॥
অনেকচিত্তবিভ্রান্তা মোহজালসমাবৃতাঃ ।
প্রসক্তাঃ কামভোগেষু পতন্তি নরকেহশুচৌ ॥১৬॥
অদ্য আমার এই লাভ হইল, পরে এই ইষ্টবস্তু পাইব, এই ধন আমার আছে, এই ধন আমার পরে হইবে, এই শত্রুকে আমি পরাজিত করিয়াছি, অন্যান্যকেও হত করিব; আমি সকলের প্রভু, আমিই সকল ভোগের অধিকারী, আমি কৃতকৃত্য, আমি বলবান্‌, আমি সুখী, আমি ধনবান্‌, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, মজা করিব – এই প্রকার অজ্ঞানে বিমূঢ়, বিবিধ বিষয়-চিন্তায় বিভ্রান্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত, বিষয়ভোগে আসক্ত ব্যক্তিগণ অপবিত্র নরকে পতিত হয় । ১৩-১৬
আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধা ধনমানমদান্বিতাঃ ।
যজন্তে নামযজ্ঞৈস্তে দম্ভেনাবিধিপূর্বকম্ ॥১৭॥
আত্মশ্লাঘাযুক্ত, অবিনয়ী, ধনমানের গর্বে বিমূঢ় সেই আসুর প্রকৃতির ব্যক্তিগণ দম্ভ প্রকাশ করিয়া অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞ করে । ১৭
অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং চ সংশ্রিতাঃ ।
মামাত্মপরদেহেষু প্রদ্বিষন্তোহভ্যসূয়কাঃ ॥১৮॥
সাধুগণের অসূয়াকারী সেই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া স্বদেহে ও পরদেহে অবস্থিত আত্মরূপী আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । ১৮
তানহং দ্বিষতঃ ক্রূরান্ সংসারেষু নরাধমান্ ।
ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানাসুরীষ্বেব যোনিষু ॥১৯॥
এইরূপ দ্বেষপরবশ, ক্রুরমতি, নরাধম, আসুরপুরুষগণকে আমি সংসারে (ব্যাঘ্র-সর্পাদি) আসুরী যোনিতে পুনঃ পুনঃ নিক্ষেপ করিয়া থাকি । ১৯
আসুরীং যোনিমাপন্না মুঢ়া জন্মনি জন্মনি ।
মামপ্রাপ্যৈব কৌন্তেয় ততো যান্ত্যধমাং গতিম্ ॥২০॥
হে কৌন্তেয়, এই সকল মূঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে আসুরী যোনি প্রাপ্ত হয় এবং আমাকে না পাইয়া শেষে আরও অধোগতি (কৃমিকীটাদি যোনি) প্রাপ্ত হয় । ২০
ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ ॥২১॥
কাম, ক্রোধ এবং লোভ – এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, ইহারা আত্মার বিনাশের মূল (জীবের অধোগতির কারণ) । সুতরাং এই তিনটিকে ত্যাগ করিবে । ২১
এতৈর্বিমুক্তঃ কৌন্তেয় তমোদ্বারৈস্ত্রিভির্নরঃ ।
আচরত্যাত্মনঃ শ্রেয়স্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥২২॥
হে কৌন্তেয়, নরকের দ্বারস্বরূপ এই তিনটি হইতে মুক্ত হইলে মানুষ আপনার কল্যাণ সাধনপূর্বক পরমগতি প্রাপ্ত হয় । ২২
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ॥২৩॥
যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না । ২৩
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ॥২৪॥
অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া (ইহায়) যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও । ২৪

(১-৩) আসুরিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে চিনে না, সুতরাং অবজ্ঞা করে; দৈবী বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে ভক্তি করে [৯|১১-১৩] । এই উভয় প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইতেছে এবং আসুরী প্রকৃতির কিরূপে সংশোধন হয় তাহাও উপদেশ দেওয়া হইয়াছে ।
(৮) অথবা মতান্তরে, জগতের শাস্ত্রোক্ত কোন সৃষ্টি-পরম্পরা নাই । জগতের সকল পদার্থই মনুষ্যের কামনা-বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য । তাহাদের অন্য কোনও উপযোগ নাই ।
(১৭) এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । [৯|১২]
(১৮) আমি অন্তর্যামিরূপে সকলের মধ্যেই আছি, কিন্তু দম্ভবশে আমার অন্তর্যামিত্ব অস্বীকার করিয়া স্বদেহস্থিত আমাকে দ্বেষ করে এবং প্রাণি-হিংসাদি দ্বারা অন্য দেহেও আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে ।
(২৩) সিদ্ধি = পুরুষার্থ প্রাপ্তির যোগ্যতা (শঙ্কর); তত্ত্বজ্ঞান (শ্রীধর) ।
(২৪) শাস্ত্র = শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণাদি । ধর্মশাস্ত্র = কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণায়ক শাস্ত্র; আধুনিকগণ ইহাকে নীতিশাস্ত্র বলেন । কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে নীতিশাস্ত্র বলিতে কেবল রাজনীতিই বুঝায় । উহা ধর্মশাস্ত্রেরই অন্তর্গত ।
(২৪) ইহ = কর্মাধিকারে বর্তমান থাকিয়া (শ্রীধর); এই লোকে (তিলক); এই কর্মাধিকার-ভূমিতে অর্থাৎ ভারতবর্ষে (শঙ্কর) । ভারতবর্ষ কর্মভূমি, মোক্ষ সাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান, দেবগণও এস্থানে জন্মগ্রহণ বাঞ্ছা করেন [বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩|৪৯-৫৬, ৬৯-৭৯; অপিচ, ভাগবত ৫|১৯-২৭] ।